
রোমের কলোসিয়াম(ফ্ল্যাভিয়ান এম্পিথিয়েটার)
কলোসিয়াম ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি বৃহৎ উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। ৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই মঞ্চ সাধারণত গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কোন প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হত। কলোসিয়াম একটি উপবৃত্তাকার কাঠামো যা ১৮৯ মিটার দীর্ঘ (৬১৫ ফিট / ৬৪০ রোমান ফুট), এবং ১৫৬ মিটার চওড়া (৫১০ ফিট / ৫২৮ রোমান ফুট)। এটির মূল এলাকা ৬ একর (২৪,০০০ মি2)। বাইরের দেয়ালের উচ্চতা হল ৪৮ মিটার (১৫৭ ফিট / ১৬৫ রোমান ফুট). ঘের মূলত ৫৪৫ মিটার (১৭৮৮ ফিট / ১৮৩৫ রোমান ফুট)। কেন্দ্রীয় রনভূমি একটি উপবৃত্তাকার এলাকা যা ৮৭ মিটার (২৮৭ ফুট) লম্বা এবং ৫৫ মিটার (১৮০ ফুট) চওড়া এবং একটি ৫ মিটার (১৫ ফুট) উচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, যা আসনবিন্যাস এর টায়ারগুল দ্বারা বেষ্টিত। এর অবস্থান রোমান ফোরামের ঠিক পশ্চিমে, যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ৭০ থেকে ৭২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোন এক সময়; এসময় সম্রাট ভেসপাসিয়ানের রাজত্ব ছিল। ভেসপাসিয়ান এটি রোমান সাম্রাজ্যের মানুষদের উপহার দিতে চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, ফ্লেবিয়ন সাম্রাজ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ানো, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য একটা মঞ্চ স্থাপন এবং স্থাপত্যবিদ্যায় রোমানদের দক্ষতা প্রদর্শন। কিন্তু তিনি এটি শেষ করে যেতে পারেননি। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তিতুসের(টাইটাস) রাজত্বকালে। পরে দোমিতিয়ানের শাসনামলে এটির আরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। এর আদি নাম ছিল ফ্ল্যাভিয়ান নাট্যশালা। কলোসিয়াম প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন যা একই সাথে রোমানদের হিংস্রতা আর নির্মাণশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হয়ে টিকে আছে শত শত বছর ধরে। রোমের বিখ্যাত যোদ্ধা গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ এবং অন্যান্য প্রদর্শনী দেখার জন্য ব্যবহৃত হত এই প্রেক্ষাগৃহ।
রোমান সম্রাটদের নির্দেশে রাজকোষের অর্থে সে সময় এক বিশেষ খেলার আয়োজন করা হতো কলোসিয়ামে। লড়ায়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হতো হাতি, গন্ডার বা সিংহের মতো হিংস্র প্রাণী। পশুর সঙ্গে-পশুর বা পশুর সঙ্গে মানুষের মরণান্তিক লড়াই দেখতে কলোসিয়ামের গ্যালারিতে জড়ো হতো হাজারো রোমান অধিবাসী। পশুদের মৃত্যুবেদনার হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো গ্যালারি। কলোসিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৯ হাজারেরও বেশি পশুর প্রাণ গিয়েছিল। এভাবে, দীর্ঘদিন পশুর লড়াই আর এগুলোর করুণ মৃত্যু দেখতে দেখতে একঘেয়েমি বোধ করেন সম্রাট তিতুস(টাইটাস)। তাই, পশুর পরিবর্তে মানুষে মানুষে লড়ায়ের হিংস্র আর অমানবিক চিন্তা মাথায় আসে তার। ফলস্বরূপ, শুরু হয় মানুষে-মানুষে লড়াই আর মৃত্যুর করুণ ও বীভৎস কাহিনী। প্রথমে যুদ্ধবন্দিদের মরণপণ লড়াই দিয়ে শুরু। যতক্ষণ না দুইজনের একজনের মৃত্যু হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত চলত লড়াই। পরে প্রচলন হয় গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াইয়ের। ‘গ্ল্যাডিয়াস’ অর্থ খাটো তরবারী। এ তরবারী দিয়ে লড়াইকারীদের বলা হতো গ্ল্যাডিয়েটর। রোমান সভ্যতায় গ্লাডিয়েটররা ছিল সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। গ্লাডিয়েটরদের কোন সামাজিক মর্যাদা থাকত না। তাদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করা হতো, ব্যবহার করা হতো এ ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের মঞ্চে। লড়াই চলাকালে কোনো এক গ্ল্যাডিয়েটর আহত হয়ে পড়ে গেলে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো কলোসিয়াম। মৃত্যু ভয়ে ভীত, ক্ষত-বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটর রেওয়াজ অনুযায়ী হাত তুলে সম্রাটের করুণা প্রার্থনা করত, প্রাণভিক্ষা চাইত। মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণ সম্রাটের মেজাজের ওপর নির্ভর করত। সম্রাট ক্ষমা করলে সে যাত্রায় বেঁচে যেত পরাজিত গ্লাডিয়েটরস আর না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত রক্ত ঝরেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে রোমের কলোসিয়াম এর এক চিলতে মাটিতে। ধারণা করা হয় কলোসিয়ামের মাটিতে চলা লড়াইয়ের প্রদর্শনীতে প্রাণ হারিয়েছে ৫ লক্ষাধিক গ্লাডিয়েটরস এবং ১০ লক্ষেরও বেশি বন্য প্রাণী।
ষষ্ঠ শতকের পূর্বে ভূমিকম্প এবং অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এটির পুননির্মাণ ও পরিবর্তন সাধন করা হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে আঠার শতক পর্যন্ত কলোসিয়াম ছিল প্রায় অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। যদিও এর মাঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সেসময়কালে এটি রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোন প্রচেষ্টা ছিল না বললেই চলে। বহু বছরের অবহেলায় কলোসিয়ামের মূল স্থাপত্যের দুই-তৃতীয়াংশ ই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু আজও এই কলোসিয়াম পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় একটি টুরিস্ট স্পট হিসেবে খ্যাত। ইতালির সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট এটি। কলোসিয়াম দেখার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায় ইতালিতে।
ইউনেস্কো কলোসিয়ামকে ১৯৯০ সালে বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়। এটি পৃথিবীতে মনুষ্যসৃষ্ট আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে নির্বাচিত হয় ২০০৭ সালে।








