
পেত্রা-Petra
নাম - পেত্রা
স্থান - জর্দান(JORDAN)
নির্মিত - সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব 5 শতকের প্রথম দিকে
আয়তন - ২৬৪ বর্গকিলোমিটার
পৃথিবীর ইতিহাসে পেত্রা একটি রহস্যের নাম। সুপ্রাচীন এই নগরীর অন্তরে লুকিয়ে আছে হাজারো ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার মাত্র ১৫% ইতিহাসবিদগণ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রাচীনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী পেত্রা যেন হঠাৎ করে কালের অতল গহ্বরে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়ে যায়। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে জেনে নিতে হবে পেত্রা সম্পর্কে। পেত্রা একটি প্রাচীন আরব শহর। বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। পেত্রা নগরীর নামকরণের সাথে গ্রিক শব্দ ‘পেত্রা’-র মিল পাওয়া যায়, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘পাথর‘। সেই অনুযায়ী পেত্রার নাম ‘পাথুরে শহর’। বাস্তবিক অর্থেও পেত্রাকে পাথরের নগরী বলা হয়ে থাকে, কারণ পেত্রা নগরীর সীমানা ঘিরে আছে লালচে পাথরশিলার বেষ্টনী। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভূক্ত পেত্রার বুকে দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে মন্দির, সমাধিক্ষেত্র, ভাস্কর্য, সৌধ, ওবেলিস্ক এবং হাজারো ধর্মীয় স্থাপনা।
৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী। পেত্রা নগরী মূলত একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। পেত্রা নগরীর প্রবেশদ্বার অত্যন্ত দুর্গম। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ গিরিপথ পেরিয়ে তবেই দেখা মিলবে এই রহস্যময় নগরীর। শহরের প্রথমেই যে স্থাপনাটি আপনার নজরে পড়বে, সেটির নাম ‘আল-খাজনেহ’। এটি পেত্রা নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কোষাগার ছিল। কিন্তু অনেকে এই তথ্যটি ভুল বলে দাবি করেন। তাদের মতে, আল-খাজনেহ একটি স্মৃতিসৌধ ব্যতিত আর কিছু নয়। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে যা কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া, মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল। গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্রথিত সেই প্রাচীন দালানগুলো যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভান্ডার নামেও পরিচিত। আরো রয়েছে একটি অর্ধগোলাকৃতির একটি নাট্যশালা যেখানে প্রায় ৩০০০ দর্শক একসাথে বসতে পারে। পেত্রা নগরী ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারধারে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরনাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বানিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো পেত্রা।
৪০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে পেত্রা বিশ্ববাসীর নিকট পরিচিতি লাভ করে। নাবাতিয়ানদের সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থার কারণে পেত্রা বাণিজ্যিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ নগরী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে পেত্রা প্রাচীনতম নগরীগুলোর মাঝে অন্যতম। নাবাতিয়ানরা পেত্রার সাহায্যে আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে লেভান্তের বড় একটি অঞ্চলের সকল ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। পেত্রার বুকে উন্নতমানের সেচ ব্যবস্থার দ্বারা ফসল ফলানো হতো। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট ট্রাজান পেত্রাকে রোম সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভূক্ত করেন। ক্যালেণ্ডারের হিসাব অনুযায়ী সময় তখন ১০৬ খ্রিস্টাব্দ। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে পেত্রার অবনতি ঘটতে থাকে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে রোমানদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য করাকে দায়ী করা হয়। মাত্র দুইশত বছরের মাথায় পেত্রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে এক প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে পেত্রার সামগ্রিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিক মন্দার মুখে ব্যবসায়ীরা পেত্রা ত্যাগ করতে থাকে। ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে পেত্রা। পরবর্তীতে ৭০০ সালে মুসলিম শাসকরা পেত্রা দখল করে নেয়। এককালের সমৃদ্ধ নগরী পেত্রা ততদিনে রূপ নিয়েছে সামান্য গ্রামে। তাই পেত্রার প্রতি শাসকদের গুরুত্ব কম ছিল। প্রথম ক্রুসেডের সময় পেত্রা মুসলিমদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেন জেরুজালেমের রাজা প্রথম বালডউইন। ১২১৭ সালে মুসলিমরা পুনরায় পেত্রা জয় করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে মামলুক সুলতান বেবারের আমলে পেত্রা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ পেত্রার নাম ভুলে যায়। ইতিহাসের পাতায় পেত্রা একটি রূপকথা হিসেবে টিকে থাকে। আরবের বেদুইনরা পেত্রার সঠিক অবস্থান জানলেও তা বাইরের মানুষদের নিকট প্রকাশ করতো না।
বহু বছর অজানা থাকার পর এই প্রাচীন শহরটিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডিগ বুর্খার্দত, ১৮১২ সালে। জন উইলিয়াম বার্গন তার নিউডিগেট পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত এক সনেটে একে বর্ননা করেছেন “a rose-red city half as old as time” বলে। বার্গন কিন্তু পেত্রাতে যাননি। বলা যেতে পারে যেতে পারেননি। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর্যন্ত শুধুমাত্র ইউরোপীয়ানরাই সেখানে যেতে পারতেন। স্থানীয় লোক আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে হত সেখানে। ইউনেস্কো এটিকে ‘বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী স্থান’ ঘোষনা করে ১৯৮৫ সালে। ঘোষনায় পেত্রাকে বলা হয় “one of the most precious cultural properties of man's cultural heritage”। পেত্রা সংস্কৃতি, সম্পদ আর ক্ষমতায় একসময় যে কত সমৃদ্ধ ছিল তা প্রমাণ করতে পেত্রার ধ্বংসাবশেষই যথেষ্ট।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পেত্রা নগরীকে ঘিরে ইতিহাসবিদগণের আগ্রহের কারণ কী? ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে নাবাতিয়ান শাসনামলে পেত্রার মতো অত্যাধুনিক এবং সমৃদ্ধ নগরী নির্মাণের জন্য উপযোগী যন্ত্রপাতি ছিল না। তাহলে পেত্রা নির্মাণে নাবাতিয়ানরা কি বহিরাগত কারও সাহায্য নিয়েছিলো? এর কোনো উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হয়, পেত্রার অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।





